জ্যোতি বসু সব সময় বলতেন:

‘‘মানুষ, একমাত্র মানুষই ইতিহাস রচনা করে। এটা ঠিকই যে মানুষ কখনো কখনো ভুলও করে। কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়ই অবশ্যম্ভাবী।’’



শুক্রবার, ২ জুলাই, ২০১০

জ্যোতি বসু(১৯১৪-২০১০)

সংক্ষিপ্ত জীবনী: জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ সালের ৮ই জুলাই তখনকার কলকাতায় হ্যারিসন রোডের একটি বাড়িতে। মা হেমলতা দেবী, বাবা নিশিকান্ত বসু। আদি বাড়ি ঢাকা জেলার বারদি গ্রামে।

নিশিকান্ত বসু ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভ করে তিনি কলকাতায় এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং তাঁর ভালই পসার হয়। এইসময়ে জ্যোতি বসুরা বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন ধর্মতলায় হিন্দুস্থান বিল্ডিং-এর ভাড়া বাড়িতে। ৬ বছর বয়সে জ্যোতি বসুকে ভর্তি করা হয় লরেটো স্কুলে। পরে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। ১৯২৪ সালে নিশিকান্ত বসু হিন্দুস্থান পার্কে নিজে বাড়ি তৈরি করে সেখানে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স থেকেই জ্যোতি বসু সিনিয়র কেমব্রিজ ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।

জ্যোতি বসু নিজেই লিখেছেন, তাঁদের পরিবারে রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ ছিল না — তবে তৎকালীন বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি ছিল। বসু তাঁর মায়ের মুখে শুনেছিলেন, ১৯১৩ সালে অনুশীলন সমিতির সদস্য বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাড়িতে পুলিস এলে জ্যোতি বসু-র মা কাপড়ের আড়ালে আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন। নিশিকান্ত বসু রাজনৈতিক প্রশ্নে নীরবই থাকতেন কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি তাঁর অটল সমর্থন ছিল। এসবই জ্যোতি বসুর মনে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ঐ বিদ্রোহের বিরোধিতা করে স্কুলে লিফলেট বিতরণ করা হয়। জ্যোতি বসু তার প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, বিপ্লবীরা তো দেশের স্বার্থেই বিদ্রোহ করেছেন। তাহলে তাঁরা অন্যায়টা কী করেছেন? পুলিসী আক্রমণে বিপ্লবীদের মৃত্যুর খবরে তাঁর মন খারাপ হয় এবং সেদিন ইস্কুলে যাননি। বাবাও কোনো আপত্তি করেননি।

১৯৩৫ সালে জ্যোতি বসু ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যান। তখন গোটা ইউরোপ অশান্ত। ইতালিতে ফ্যাসিস্ত মুসোলিনির উত্থান হয়েছে, তারা আবিসিনিয়া দখল করেছে। জার্মানিতে ক্ষমতায় এসেছে হিটলার। ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে জোরকদমে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। জাপান-চীন আক্রমণ করেছে। তখন ইংল্যান্ডের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলছে রাজনীতি বিষয়ক তুমুল তর্কবিতর্ক। হ্যারল্ড ল্যাস্কি তাঁর ফ্যাসিবিরোধী ভাষণ দিচ্ছেন। এই পরিবেশে ছাত্র জ্যোতি বসু নিজেও ফ্যাসিবিরোধী পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলেন। ভি কে কৃষ্ণমেননের নেতৃত্বে ভারতীয় ছাত্ররা তৈরি করলেন ইন্ডিয়া লিগ। জ্যোতি বসু তাদের অন্যতম। এই সময়ে ব্যারিস্টারি পড়তে এলেন ভূপেশ গুপ্ত, স্নেহাংশুকান্ত আচার্য চৌধুরী — যাঁদের সঙ্গে জ্যোতি বসুর গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। এই সময়ে স্নেহাংশু আচার্যের দৌলতে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেনের (সি পি জি বি) নেতা হ্যারি পলিট, রজনীপাম দত্ত, বেন ব্র্যাডলির সঙ্গে। তাঁরা ইন্ডিয়া লিগকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে জনমত গঠনই ছিল ইন্ডিয়া লিগের কার্যক্রম। এই সময়ে লন্ডন, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডে তৈরি হয় কমিউনিস্ট গ্রুপ। এই সময়ে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করা যেত না, কারণ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। জ্যোতি বসুরা বিভিন্ন মার্কসবাদী পাঠচক্রে যোগ দিতেন। তাঁদের ক্লাস নিতেন হ্যারি পলিট, রজনীপাম দত্ত, ক্লিমেন্স দত্ত, বেন ব্র্যাডলি প্রমুখ। স্পেনে ফ্রাঙ্কোর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দুনিয়ার প্রগতিশীল লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী এতে অংশ নেন। এইসব ঘটনা তরুণ জ্যোতি বসুর মনকে আলোড়িত করে। এই সময়ে গঠিত হয় লন্ডন মজলিস। জ্যোতি বসু হন তার প্রথম সম্পাদক। রজনী প্যাটেল, পি এন হাকসার, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ইউসুফ মেহের আলি খান প্রমুখ এতে যোগ দেন। নেহরু লন্ডনে এলে জ্যোতি বসুরা তাঁকে সংবর্ধনা দেন। নেহরুকে তাঁরা বলেন, আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তখনই মনস্থির করেন দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করবেন। এসময়ে গ্রেট ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে তাঁরা নিরক্ষর ভারতীয় নাবিকদের মধ্যে সাক্ষরতা প্রসারের কাজও করেন। হ্যাম্পস্টেড হিথে ফ্যাসিস্তদের এক জনসভায় প্রতিবাদ করেন জ্যোতি বসু। কারণ ঐ সভার বক্তারা ভারত তথা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বদনাম করছিলেন।

১৯৪০ সালে ব্যারিস্টারি পরীক্ষা শেষ করে জ্যোতি বসু দেশে ফেরেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের নজর এড়িয়ে তিনি বেশ কিছু কমিউনিস্ট বইপত্র ভারতে নিয়ে আসেন। তিনি ভূপেশ গুপ্ত, মোহনকুমার মঙ্গলম ও অরুণ বসু মহারাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে যোগাযোগ করেন। কলকাতায় এসে হাইকোর্টে নাম লেখান জ্যোতি বসু, কিন্তু সেই থেকে কোনো দিনই প্র্যাকটিস করেননি। কারণ তখনই মনস্থির করে ফেলেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হবেন।

এই সময়ে বিশ্বযুদ্ধের চরিত্র পরিবর্তন হয়। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে বিশ্বযুদ্ধ জনযুদ্ধের চরিত্র গ্রহণ করে। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত সুহৃদ সঙ্ঘ ও ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ। জ্যোতি বসু হন তার সম্পাদক। এই সময়ে তাঁর প্রথম বিবাহ হয় ছবি ঘোষের সঙ্গে, যদিও বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটে। মা হেমলতা দেবীর মৃত্যু হয় কিছুদিন পরেই।

কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে জ্যোতি বসুর কাজ ছিল আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করা। এরপর ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে শ্রমিকদের সংগঠন গড়ার কাজ করতে বলে। বঙ্কিম মুখার্জি, সরোজ মুখার্জিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি শ্রমিক সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়াতে থাকেন যুক্তবঙ্গের বিভিন্ন প্রদেশে। ১৯৪৪ সালে জ্যোতি বসুদের তৎপরতায় গঠিত হয় বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। বসু হন তার প্রথম সম্পাদক। ১৯৪৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

সে এক অগ্নিগর্ভ সময়। উত্তাল ১৯৪৬ সাল। নৌ-বিদ্রোহ, ডাক ধর্মঘট, বন্দী মুক্তি আন্দোলন, রশিদ আলি দিবস সব মিলিয়ে উত্তপ্ত বাতাবরণ। এহেন পরিবেশে কমিউনিস্ট জ্যোতি বসু এলেন বিধানসভায়।

প্রশ্ন ছিল অনেকের মনে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান। বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। এমন তরুণ কি কমিউনিস্ট আন্দোলনে ধোপে টিকবে? কারণ, কমিউনিস্টদের রাস্তা ফুল বিছানো নয়। কিন্তু যে চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকলে কমিউনিস্ট নেতা হওয়া যায় জ্যোতি বসুর মধ্যে তা মানুষ প্রত্যক্ষ করলেন অচিরেই।

১৯৪৬ সালে রেলওয়ে শ্রমিক কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হুমায়ুন কবীরকে পরাস্ত করে জ্যোতি বসু নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে বছর আরও দুই কমিউনিস্ট প্রার্থী বিধানসভার সদস্য হয়েছিলেন। দার্জিলিঙ কেন্দ্রে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও দিনাজপুর কেন্দ্রে রূপনারায়ণ রায়। সুরাবর্দির নেতৃত্বে বঙ্গদেশে মুসলিম লিগ সরকার গঠন করল।

সে বছরের ২৫শে জুলাই জ্যোতি বসু বিধানসভায় প্রথম বক্তৃতা দিলেন। বিষয় বাংলার খাদ্য সঙ্কট। সেই প্রথম ভাষণই বহুজনের নজর কেড়েছিল। অমৃতবাজার পত্রিকা ও অন্যান্য পত্রিকায় তা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল। সেই শুরু।

তারপর কত না ঘটনা। বন্দীমুক্তির দাবিতে সরব সাধারণ মানুষ। বিধানসভার ভিতরে তাঁদের দাবিকে উপস্থিত করছেন কমিউনিস্ট সদস্যরা। ২৯শে জুলাইয়ের ডাক ধর্মঘটে অচল সারা বাংলাদেশ। অচল বিধানসভাও। কুখ্যাত ডেপুটি পুলিস কমিশনার সামসুদ্দোহা গ্রেপ্তার করলেন জ্যোতি বসুকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বসুর কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন। জ্যোতি বসু, রূপনারায়ণ রায়, রতনলাল ব্রাহ্মণরা বিধানসভায় তুলছেন জমিদারী প্রথা বিলোপের দাবি, চটকল জাতীয়করণের দাবি, কৃষকদের বিনামূল্যে জমি বিতরণের দাবি। প্রতিটি বিষয়েই নতুন কথা যা আগে কেউ কখনও শোনেনি। প্রতিটি বিষয়ে বিকল্প বক্তব্য। জ্যোতি বসু উপস্থিত করছেন গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী। বিরোধিতার নামে এখনকার মতো শুধু অহেতুক হইচই বিশৃঙ্খলা নয়। সুনির্দিষ্ট বক্তব্যে জেরবার হচ্ছে সরকারপক্ষ। সরকারী আসনে বসে বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদ মহতাবদের মতো ধনাঢ্যরা। তাঁদের শ্রেণীচরিত্র উন্মোচনেও তীক্ষ্ণ জ্যোতি বসু। নৌ-বিদ্রোহীদের সমর্থনে জ্যোতি বসু, মহম্মদ ইসমাইলদের নেতৃত্বে বি এ রেলওয়েতে ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘট হচ্ছে। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত কলকাতায় নারকেলডাঙা শ্রমিক লাইনেও উপস্থিত তিনি। মহম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছেন দাঙ্গায় আটকে পড়া সহযোদ্ধাদের উদ্ধার করতে। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিধানসভায় বসু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা কি আজও প্রাসঙ্গিক নয়? আবার সেই বছরই তিনি বেরিয়ে পড়ছেন তেভাগা সংগ্রামীদের উপর দমন-পীড়নের রিপোর্ট নিতে উত্তরবঙ্গে। ছুটে যাচ্ছেন স্নেহাংশু আচার্যের সঙ্গে ময়মনসিংহে হাজং যোদ্ধারের পাশে। ময়মনসিং থেকে জ্যোতি বসুকে বহিষ্কার করলো পুলিস প্রশাসন। তেভাগা থেকে স্লোগান উঠেছে ‘জান দেব তবু, ধান দেব না।’ বিধানসভার ভিতরে জ্যোতি বসু বলছেন ‘সামিরুদ্দিন ও শিবরামের আত্মদান ব্যর্থ হবে না।’

১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বিবাহ হয় কমল বসুর।

স্বাধীন দেশে বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম দিনেই জনসাধারণের উপর কংগ্রেসী সরকারের পুলিসী লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস। বিধানসভায় প্রফুল্ল ঘোষের কালাকানুনের বিরোধিতা করছেন জ্যোতি বসু। তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা, ‘সর্বশক্তি দিয়ে এ কালাকানুন আমরা প্রতিরোধ করব।’

আবার এই পরিস্থিতিতেই কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলো। বিনাবিচারে গ্রেপ্তার হলেন জ্যোতি বসু। মুক্তি পেলেন ৩ মাস পর। পার্টির পরামর্শে আত্মগোপন করছেন। ছদ্মবেশে এবং ‘বকুল’ ছদ্মনামে নেতৃত্বের নির্দেশ গোপনে পৌঁছে দিচ্ছেন। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে রান্না করছেন, ঝাঁট দেওয়া, বাসন ধোওয়া ইত্যাদি। গেরস্থালির কাজ সামলাচ্ছেন, তেলেঙ্গানার সংগ্রামীদের মুক্তির দাবিতে ছুটে যাচ্ছেন জওহরলাল নেহরুর কাছে, বিধায়ক হিসাবে প্রাপ্য অর্থ তুলে দিচ্ছেন পার্টি তহবিলে এবং পার্টির ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ করছেন শৃঙ্খলার সঙ্গে। ১৯৫২ সালে তাঁর পুত্র চন্দন বসুর জন্ম হয়। ১৯৫১ সালে নবপর্যায়ে দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা শুরু হলে জ্যোতি বসু হন সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। ১৯৫২ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।

স্বাধীন ভারতে প্রথম নির্বাচনে ১৯৫২ সালে বরানগর কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীকে পরাস্ত করে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হলেন। এই নির্বাচনে কমিউনিস্টদের আসন সংখ্যা বেড়ে হলো ২৮ জন। কিন্তু সেদিন বিধানসভায় অধ্যক্ষ হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে তাঁকে বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি দেননি, তবে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসাবে মেনে নেন। কংগ্রেসের অপশাসন সম্পর্কে বসুর তীক্ষ্ণ ভাষার প্রতিবাদ তখনও থেমে থাকেনি। ১৯৫৩ সালের ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনের সময় পুলিস তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। শিল্পে শান্তিরক্ষার নামে কালাকানুন আনার কঠোর বিরোধিতা করে জ্যোতি বসু সেদিন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কেও ‘স্বেচ্ছাচারী’ বলতে কসুর করেননি। বসু তাঁকে বলেছিলেন, ‘আইনের শাসন কাকে বলে আপনি জানেন না। আবার ১৯৫৪ সালে শিক্ষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়নের নিন্দায় জ্যোতি বসুর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেছে। পুলিসের গ্রেপ্তার এড়াতে সাতদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন বিধানসভায়। আবার বিধানসভাতে বসেই শিক্ষকদের দাবি নিয়ে সরকারপক্ষের সঙ্গে মীমাংসা করিয়েছিলেন। কিন্তু সাতদিন পর বিধানসভা থেকে বেরোতেই পুলিস তাঁকে গ্রেপ্তার করল। জেলে আটকে রাখল দু’দিন।

১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বরানগরে কংগ্রেস প্রার্থী কানাইলাল ঢোলকে পরাস্ত করে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হলেন জ্যোতি বসু। এই বিধানসভাতেই বসুকে বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলেন অধ্যক্ষ। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে পিছিয়ে আসেননি তিনি। উদ্বাস্তু সমস্যা, বস্তি সমস্যা সম্পর্কে বিরামহীনভাবে বলে যাচ্ছেন জ্যোতি বসু ও অন্যান্য কমিউনিস্ট বিধায়করা। ১৯৫৮ সালে জ্যোতি বসুই প্রথম কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিতে বিধানসভায় আলোচনা করেছিলেন। প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই দাবিতে সকল দল মিলে কেন্দ্রের কাছে ডেপুটেশন দেবার। সেদিন তাঁর কিছু দাবির যৌক্তিকতা ডাঃ রায়ও স্বীকার করে নিয়েছিলেন। জ্যোতি বসুকেই দেখা গেছে খাদ্য আন্দোলনের সময় নৃশংস কংগ্রেস সরকারের বর্বরতার ও ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিতে। কায়েমীস্বার্থের চক্ষুশূল হয়েছিলেন বলেই ১৯৫৯ সালে কংগ্রেসী সমাজবিরোধীরা বরানগরে তাঁর উপর আক্রমণ করেছিল। গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সহকর্মীরা রক্তাক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে বসু গিয়েছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে স্তালিনের ভাবমূর্তি নষ্ট করার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত শুরু হয়। এ অবস্থায় ১৯৬১ সালে অবিভক্ত পার্টির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলে জ্যোতি বসু ছিলেন। তাঁরা সুশলভ ও পনোমারিয়েভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বসু সোভিয়েত নেতাদের কাছে জানতে চান, স্তালিনের সময় আপনারাই নেতা ছিলেন। তখন সমালোচনা করেননি কেন?

একই সময়পর্বে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক নেতৃত্বও তাঁকে নিতে হয়েছে। ১৯৫৩-৫৪ সালে ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলনে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। টানা ১৯৬১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ঐ পদে ছিলেন।

১৯৬২ সালের নির্বাচনে জ্যোতি বসু চতুর্থবারের জন্য জিতে এলেন বরানগর কেন্দ্র থেকেই। এবার পরাজিত হলেন কংগ্রেসেরই ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি। ১৯৬৩ সালে বিধানসভার অভ্যন্তরে তাঁকে শুনতে হয়েছে ‘চীনের দালাল’ ও আরও কত না বিশেষণ। সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন জ্যোতি বসু। চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ সম্পর্কে পার্টির বক্তব্যকে দৃঢ়তার সঙ্গে উপস্থিত করেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন শান্তিপূর্ণভাবেই দু’দেশের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে নিতে হবে। জ্যোতি বসু যে মাথা নোয়ানোর মানুষ নন, বরং প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেই যে তাঁকে আরও বেশি চেনা যায় সেদিন তা প্রমাণ হয়েছিল। তবু আনন্দবাজার লিখেছিল ‘জ্যোতি বসুর অগস্ত্য যাত্রা’। বলাইবাহুল্য ইতিহাসের বিচারে সেদিনের এইসব কুৎসা আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এই সময়েই কংগ্রেস সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল আরও অনেক পার্টিনেতাদের সঙ্গে অথচ সংঘর্ষ তখন থেমে গেছে। বসু আটক রইলেন এক বছরের জন্য। জেলে থাকাকালীনই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়।

প্রবল মতাদর্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল সি পি আই (এম)। সেই লড়াইয়েরও অন্যতম নেতা, জ্যোতি বসু। ১৯৬১ সালে অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়াদাতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির শেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই পার্টিতে মতাদর্শগত বিরোধ প্রকট হয়েছে। ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন সংশোধনবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে বত্রিশজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ওয়াকআউট করেছিলেন জ্যোতি বসু তাঁদের মধ্যে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত তেনালী কনভেনশনেরও অন্যতম শীর্ষ সংগঠক ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন জ্যোতি বসু। এই কংগ্রেস থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটি তথা পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে সি পি আই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসি আত্মপ্রকাশ করলে জ্যোতি বসু হন তাঁর প্রথম সম্পাদক। ১৯৬৭ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে যে বাম হঠকারিতার বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত হয়েছিল বসু ছিলেন তার সামনের সারিতে। আর তাই নকশালপন্থী অতিবিপ্লবীদের আক্রমণে ও ব্যক্তিগত কুৎসার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলেন জ্যোতি বসু।

কংগ্রেসের অপশাসনে মানুষের ক্ষোভ তখন চরমসীমায়। ১৯৬৭ সালে বরানগর কেন্দ্রে কংগ্রেসের অমরেন্দ্র ভট্টাচার্যকে হারিয়ে বসু নির্বাচিত হলেন পঞ্চমবারের জন্য। প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হলো প্রথম অকংগ্রেসী সরকার, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। আসন সংখ্যার বিচারে সি পি আই (এম) দাবি করতে পারত মুখ্যমন্ত্রিত্বের। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু বাংলা কংগ্রেস বেঁকে বসলো। অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী হলেন। জনগণের স্বার্থে সি পি আই (এম) তা মেনে নিলো। জ্যোতি বসু তার উপমুখ্যমন্ত্রী। অস্থির রাজনীতি, দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনীতির পালাবদল। বিশ্বাসঘাতকদের জন্য ভেঙে গেল যুক্তফ্রন্ট। তবু ১৯৬৯ সালে বরানগরে কংগ্রেসের অমরেন্দ্র ভট্টাচার্যকে পরাজিত করে জনগণ জ্যোতি বসুকেই জয়ী করলেন। ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আর একবার দেখলেন তাঁর দৃঢ়চিত্ততা। একদল মারমুখী পুলিসকর্মী বিধানসভায় জ্যোতি বসুর ঘরে ঢুকে তার প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে আত্মসমর্পণ করলেন।

জনগণের সমাবেশ বাড়ছে। বাড়ছে শত্রুও। তাই ১৯৭০ সালে পাটনা স্টেশনে আনন্দমার্গীরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করল। অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। ধিক্কারে ফেটে পড়ল গোটা পশ্চিমবঙ্গ, গোটা দেশ। তখন পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বারুইপুরে জনসভা করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন জ্যোতি বসু ও জ্যোতির্ময় বসু। গাড়ি ভাঙচুর হলো। সভার আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো। সভা পণ্ড হলো। জ্যোতি বসুর নির্দেশে পার্টিকর্মীরা প্ররোচনায় পা দিলেন না। এই ঘটনাতেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। পরে এক শিক্ষক প্রতিনিধি দলকে সিদ্ধার্থশঙ্কর বলেছিলেন, ওটা এমন কিছু ব্যাপার না। জ্যোতি বসুর গাড়িতে ২ জন চাপা পড়েছিলো বলেই ঐ কাণ্ড ঘটেছে।

আবার আক্রান্ত হলেন জ্যোতি বসু। বসিরহাটে জনসভা করতে গিয়ে। সঙ্গে ছিলেন আবদুল্লাহ রসুল ও অন্যান্যরা। গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা মারা হয়। দু’টি বোমা গাড়ির ইঞ্জিনে লেগে গাড়িটি ভীষণরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৭১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে শ্যামপুকুরে খুন হলেন শ্রদ্ধেয় জননেতা হেমন্ত বসু। উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এ ঘটনার দায় চাপালেন সি পি আই (এম)-র ঘাড়ে। ফলে শহরের কিছু মানুষ মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হলেন। তবু ঐ নির্বাচনে সি পি আই (এম) একক বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো। জ্যোতি বসু জিতলেন বরানগরেই। পরাজিত প্রার্থী অজয় মুখার্জি। কিন্তু সর্বাধিক আসন পাওয়া সত্ত্বেও সি পি আই (এম)-কে সরকার গঠনের জন্য ডাকলেন না রাজ্যপাল।

কার্যত পশ্চিমবঙ্গে জরুরী অবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছিলো ১৯৭২ সাল থেকেই।

জনগণের জয়যাত্রাকে পথ আটকাতেই ১৯৭২ সালে কংগ্রেস বেছে নিলো রিগিংয়ের রাস্তা। সেদিন নির্বাচনের নামে পুরোপুরি প্রহসন হয়েছিলো। বরানগরে গিয়ে জ্যোতি বসু স্বচক্ষে দেখলেন তাদের কুকীর্তি। বেলা বারোটার মধ্যেই বসু ঐ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি সিদ্ধার্থ রায়ের বিধানসভাকে ‘জোচ্চোরদের বিধানসভা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। শাসকদলের পক্ষে সাহস হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে বিধানসভায় স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব আনার।

পশ্চিমবঙ্গের একাত্তর থেকে সাতাত্তরে আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের ও জরুরী অবস্থার দিনগুলিতে জনগণ জ্যোতি বসুকে পেয়েছেন তাঁদের পাশে এবং সামনে। বহু নেতা, শতশত কর্মীর রক্ত ঢালা পিচ্ছিল পথে তাঁকে এগোতে হয়েছে। এগিয়েছেন রাজ্যের জনগণও।

গণ-আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষেই ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আবির্ভাব। সাতগাছিয়া কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বিধানসভায় ফিরে এলেন জ্যোতি বসু। এবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সেদিন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকে প্রথম প্রশ্নই ছিলো, আপনি কি মনে করেন আপনার সরকার স্থায়ী হবে? জ্যোতি বসু বলেছিলেন, আমাদের বিশ্বাস আছে স্থায়ী হবে। কারণ অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে বামফ্রন্ট।

১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসু যখন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হন তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর। সাধারণত এই বয়সে মানুষ অবসর নেন। কিন্তু জ্যোতি বসুর ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো।

মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বসু ঘোষণা করলেন, আমরা কেবলমাত্র রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে সরকার পরিচালনা করবো না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জনসাধারণ ও বিভিন্ন গণসংগঠনের পরামর্শ নিয়েও এই সরকার চলবে।

জ্যোতি বসু মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। নকশালপন্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৭০০০ রাজনৈতিক বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। ১০,০০০ মামলা প্রত্যাহার করা হয়। রাজনৈতিক কারণে কর্মচ্যুত প্রত্যেক সরকারী কর্মচারীর চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বস্তুত তাঁর নেতৃত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সিদ্ধান্তগুলির ফলাফল ছিলো সুদূরপ্রসারী।

অগ্রাধিকার পেয়েছিলো ভূমি সংস্কারের কাজ। চালু হয় অপারেশন বর্গা। ফিরিয়ে দেওয়া হয় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার। বসু ঘোষণা করেন, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে পুলিসী হস্তক্ষেপ ঘটবে না। তাঁরই মন্ত্রিসভা নিয়মিত পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন।

বস্তুত বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার দিন থেকে বিশেষত এরাজ্যের বিরোধীপক্ষ সরকারের সঙ্গে শুধু অসহযোগিতাই নয়, পদে পদে তার কাজে বাধা সৃষ্টি করে এসেছে। কিন্তু সেই বাধা ঠেলে, ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে বামফ্রন্ট সরকার তার ২১ দফা কর্মসূচী রূপায়িত করেছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৮ সালেই পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হয়। এই বন্যার মোকাবিলায় আশ্চর্য সাফল্য দেখিয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকার। এক বিরাট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলো সেদিনের নবগঠিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত। কোনও মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেননি। এই সময়েই বিনোবা ভাবে হঠাৎই পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় গো-হত্যা বন্ধের জন্য অনশন শুরু করেন। এর ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির আশঙ্কা ছিলো। বসুর চেষ্টায় ও প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের হস্তক্ষেপে বিনোবা ভাবে অনশন প্রত্যাহার করেন।

১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পুনরায় দিল্লিতে ক্ষমতায় ফেরে। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের লম্ফঝম্ফ শুরু হয়। সেদিন জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এই জয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বিপন্ন এই অজুহাতে কলকাতার রাস্তায় মারমুখী হয়ে ওঠে কংগ্রেস। ১৯৮১ সালের ৩রা এপ্রিল কংগ্রেসী দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমার আক্রমণে ১৫ জন নিরীহ বাসযাত্রী মারা যান। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে পশ্চিমবঙ্গে। প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছিলেন জ্যোতি বসু। সেই সময় খবরের কাগজগুলি নিয়মিত খবর ছেপেছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার যেকোন মুহূর্তে বামফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দেবে। কিন্তু তাদের সে সাহস শেষ পর্যন্ত হয়নি।

ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে নতুন করে এসমা, নাসা প্রভৃতি কালা কানুন লাগু করেন, যদিও জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার তা পশ্চিমবঙ্গে কার্যকর করেনি।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতি বসুর বিরাট ভূমিকা ছিলো কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্নটি সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে তুলে নিয়ে আসা। বৃহৎ শিল্প স্থাপনে কেন্দ্রের লাইসেন্স প্রথা, মাসুল সমীকরণ নীতি, রাজ্যগুলির আর্থিক সামর্থ্যকে শুকিয়ে মারার চক্রান্তের বিরুদ্ধে বসু ছিলেন সরব। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৩ সালে সারকারিয়া কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অকংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। যদিও এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচার চরম আকার নেয়। সীমান্তবর্তী রাজ্য এই অজুহাতে ইন্দিরা গান্ধী বিধাননগরে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স করার অনুমতি দেননি। অবিচার চলতে থাকে হলদিয়া পেট্রোকেম ও বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণেও। সেদিন জ্যোতি বসুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প আমরা তৈরি করবোই। এ হলো পশ্চিমবঙ্গের আত্মমর্যাদার প্রতীক। সেদিন তাঁর আহ্বানে সারা দিয়ে হাজার হাজার যুবক-যুবতী বক্রেশ্বর প্রকল্পে রক্তদান করেছিলো। বহু মানুষ তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে অর্থ সাহায্য করেছিলেন, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছিলেন। এই নিয়ে কিছু সংবাদপত্র ব্যঙ্গ করলেও বক্রেশ্বর প্রকল্প নির্মাণের কাজ শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। জ্যোতি বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ পদযাত্রা করেছেন হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস প্রকল্প নির্মাণের জন্য। ১৯৮৫ সালেই বামফ্রন্ট সরকার যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ শিল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে হলদিয়া প্রকল্পও রূপায়িত হয় কেন্দ্রের সহযোগিতা ছাড়াই।

১৯৮৬ সালে দার্জিলিঙ জেলায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপ নেয়। তাদের হিংসাত্মক আন্দোলনে দার্জিলিঙ অশান্ত হয়ে ওঠে। এই সময়ে জ্যোতি বসুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় রাজ্যভাগ প্রতিহত করা যায় এবং গঠিত হয় দার্জিলিঙ গোর্খা পার্বত্য পরিষদ।

কেন্দ্রীয় অবিচারের বিরুদ্ধে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ যখন সরব, তখন ১৯৮৭’র বিধানসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে এলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন ১০০৭ কোটি টাকার সাহায্য প্রকল্পের। সেদিন জ্যোতি বসু এই অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ফানুস চুপসে দিয়ে বলেছিলেন, টাকার থলি দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কেনা যাবে না। সেই নির্বাচনের ফলাফলেই তা প্রমাণিত হয়েছিলো।

এই প্রসঙ্গে বলতে হয় ১৯৮৪ সালে দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গেও দাঙ্গা বাধানোর ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। সেদিন জ্যোতি বসুর নির্দেশে প্রশাসন দ্রুত হস্তক্ষেপ করে। পশ্চিমবঙ্গে যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ অটুট থাকে সে বিষয়ে বসু ছিলেন সদা সতর্ক। বিশেষ করে জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বি জে পি’র উত্থান তাঁকে উদ্বিগ্ন করেছিলো। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর তিনিই বলতে পেরেছিলেন, এ হলো অসভ্যতা ও বর্বরতা। তিনবিঘা চুক্তি সম্পাদন ও ফরাক্কা জল চুক্তির বিষয়ে জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্ব দিয়ে বিচার করলে জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনকে ধরা যাবে না। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন এক সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ভারতবর্ষের এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে যাননি। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বাঁক ও মোড়ে তাঁর বিচক্ষণ হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছে বারে বারে! বিরোধীদের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন নিজ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। প্রচারের জন্য তিনি কোনদিনই লালায়িত ছিলেন না। বরং প্রচারমাধ্যমই তাঁকে অনুসরণ করেছে। দুঁদে সাংবাদিকরাও তাঁকে প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলতে পারতেন না। সব সময়ে মাথা উঁচু রেখেই প্রত্যুত্তর করতেন। যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই জ্যোতি বসুকে স্বমূর্তিতে পাওয়া যেত। ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব এসেছিলো। কিন্তু সি পি আই (এম) যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

জ্যোতি বসু সি পি আই (এম)-র জন্মলগ্ন থেকেই পলিট ব্যুরোর সদস্য ছিলেন। তিনি সি পি আই (এম)-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। সংশোধনবাদ ও পরে সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বহু ঝড়ঝাপটাকে তিনি সামলেছেন অকুতোভয়ে।

সারা জীবনে গ্রেট ব্রিটেন ছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইজরায়েল, হল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ডসহ বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর বহু নামজাদা রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন তিনি। বহির্বিশ্বে ভারতের কমিউনিস্ট নেতা হিসাবে তাঁর থেকে বেশি পরিচিতি আর কারোরই হয়নি।

২০০০ সালের নভেম্বরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেন। তখনই তিনি বলেছিলেন, আমি মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নিচ্ছি—তবে রাজনীতি থেকে নয়। কমিউনিস্টরা অবসর নেয় না। যতদিন শরীর অনুমতি দেবে ততদিন মানুষের মুক্তির সংগ্রামে কাজ করে যাবো।

২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকার গঠিত হয় বামপন্থীদের বাইরে থেকে সমর্থনের ভিত্তিতে। এই সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জ্যোতি বসু ও হরকিষেণ সিং সুরজিতের বিশেষ ভূমিকা ছিলো। ২০০৫ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সি পি আই (এম)-র অষ্টাদশ কংগ্রেসে জ্যোতি বসু পলিট ব্যুরোয় পুনর্নির্বাচিত হন, যদিও তিনি নিজে শারীরিক কারণেই পলিট ব্যুরো থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি প্রচারাভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে কোয়েম্বাটোরে অনুষ্ঠিত সি পি আই (এম) ঊনবিংশ কংগ্রেসে বসু পলিট ব্যুরোর স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে বসুর শরীর ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। অনেকদিনই কানে কম শুনছিলেন। দৃষ্টিশক্তিও কমে আসছিলো। শরীরের অন্যান্য কষ্ট তো ছিলোই। তবু মস্তিষ্ক ছিলো সজাগ। ২০০৯ সালে ইন্দিরা ভবনের বাইরে বেরনোর মতো অবস্থা থাকলো না। তবু সেখানে বসেই পার্টির তথা সরকার পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া, নানা ধরনের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচীতে তিনি অংশ নিয়েছেন।

সারা জীবনে জ্যোতি বসু অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘যত দূর মনে পড়ে’।

সেই অর্থে জ্যোতি বসু বাগ্মী ছিলেন না। কিন্তু সহজ-সরল ভাষায় মানুষের মনকে ছুঁতে পারতেন তিনি। জনগণের কাছে পরিস্থিতির খোলামেলা বিশ্লেষণ করতেন। তিনি বারে বারে বলতেন, যে কাজ করতে পেরেছি তা যেমন মানুষকে বলতে হবে — যা পারিনি তা কেন পারিনি মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। তাঁর ভাষণ শোনা ছিলো এক রাজনৈতিক শিক্ষা। জনসাধারণের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, তাঁদের সঙ্গে মিশে থাকার পরামর্শ দিতেন কমিউনিস্ট কর্মীদের। প্রবল ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি স্নেহপ্রবণ অমায়িক মানুষ ছিলেন বসু। যিনিই তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ করেছেন তাঁরই এক অভিজ্ঞতা। মানুষকে সম্মান দিতে জানতেন, তাই পেয়েছেনও সম্মান। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তো বটেই—কৃষক, কর্মচারী, শিক্ষক, ছাত্র, যুব, মহিলা সহ বিভিন্ন আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বিরামহীনভাবে ছুটে গেছেন দেশের নানা প্রান্তে। পশ্চিমবঙ্গের এমন কোন এলাকা ছিলো না যেখানে বসু যাননি। তাঁর দৃপ্ত হাঁটাচলা, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। বারে বারে ইতিহাসের বহু বাঁক ও মোড়ে সঙ্কটের সময়ে দুর্দমনীয় সাহস ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন জ্যোতি বসু। জ্যোতি বসুর জীবন-ইতিহাস এক সাহসের ইতিহাস। সারাজীবন জনগণের জন্য, জনগণের মুক্তির জন্য, জনগণের সঙ্গে তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন জননেতা জ্যোতি বসু। তাই যেখানেই জ্যোতি বসু, সেখানেই জনস্রোত, সেখানেই ‘জ্যোতি বসু লাল সেলাম’ ধ্বনি। এর কখনও ব্যতিক্রম হয়নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন